খনার বচনে নিমকে কবিরাজের সাথে তুলনা করা হয়েছে। ‘নিম তিতা, নিশিন্দা তিতা, তিতা পীতরাজ। সর্বরোগের ওষুধ ধরে তাইতো কবিরাজ’।
নিমের বৈজ্ঞানিক নাম AZADIRACHTA INDICA। ঔষধি গাছটির ডাল, পাতা, রস, শিকড়, ছাল ফল সবই কাজে লাগে। একটি পূর্ণ বয়স্ক গাছ সর্বোচ্চ ৪০-৫০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। ২.৫-৪ ইঞ্চি লম্বা নিম পাতা কাস্তের মত বাঁকানো, কিনারায় ১০-১৭ টি করে খাঁজকাটা থাকে। নিমের ফল দেখতে আঙুরের মতো। সহজে নষ্ট হয় না ও পোকা ধরে না বলে প্রাচীনকাল থেকেই এখনো বিভিন্ন আসবাবপত্র ও বাদ্যযন্ত্র বানানোর জন্য এর কাঠ ব্যবহার করা হচ্ছে। নিমের বহুমুখী গুণাগুণের কথা বিবেচনা করেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘একুশ শতকের বৃক্ষ’ বলে ঘোষণা দিয়েছে।
নিমের কোন অংশের কি কাজঃ-
১. পাতা: হাম বা চিকেন পক্স হলে নিম পাতাওয়ালা ডাল গায়ে বুলালে রোগ সেরে যায়। নিম পাতা বিছানায়, কাপড়-চোপড়ে রেখে দিলে ছত্রাক ও পোকামাকড়ের আক্রমণ হয়না। নিম পাতা পোড়ানোর ধোঁয়া ঘরে ছড়িয়ে দিলে ঘরের ভেতরের রোগ জীবাণু মারা যাবে। নিম পাতা আর হলুদ বাটা রূপর্চচার কাজেও ব্যবহার হয়ে থাকে।
২. ছাল: নিমের ছালে ইউনোমড্যুলটেরি পললিস্যাকারাইড নামের একটি যৌগ আছে যা শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে সহায়তা করে ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
৩. নিম ডাল: নরম নিম ডালে দাঁত মাজলে দাঁতের মাড়ির স্বাস্থ্য ভালো থাকে। অসুখ ও সংক্রামণ মুক্ত রাখে।
৪. নিম চা: ১/৪ কাপ তাজা নিমপাতা ভাল মতো ধুয়ে পরিস্কার করে নিন। এরপর এর উপর ফোটানো গরম পানি দিন। ৫ মিনিট ভিজিয়ে রেখে এরপর ছেঁকে চায়ের মতোই পান করুন। এতে জ্বর, রক্তের সুগার কমে যাওয়ার পাশাপাশি নিমের কড়া চা ক্ষত বা আঘাত সারাতেও কাজে লাগে।
৫. নিম তেল: নিম তেলে ট্রাইগ্লাসিরাইড, ট্রাইটারপনিয়েডনামের যৌগ আছে। চামড়ার যেকোনো প্রদাহে নিমের তেল বেশ ভালো কাজে লাগে।
৬. নিম কাঠ: নিম কাঠের তৈরি আসবাবপত্রে ঘুন, উই পোকা আর ছারপোকা ধরে না। ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আসবাব বানাতে প্রাচীন কাল থেকেই ব্যবহার হয়ে আসছে।
নিমের অসাধারণ সব গুণ–
নিম পাতা যে উপকারী তা আমরা সবাই জানি। প্রায় ৪ হাজার বছরের বেশি সময় ধরে আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় এটি অন্যতম মূল উপাদান। নিমের ঔষধি গুণে মুগ্ধ হয়ে পশ্চিমারাও আজকাল ঝুঁকে পড়ছে ভেষজ ও আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় ।
১. খোঁসপাচড়া ও চুলকানি
নিম পাতা সেদ্ধ করে সেই পানি দিয়ে গোসল করলে খোঁসপাচড়া চলে যায়। পাতা বা ফুল বেটে গায়ে কয়েকদিন লাগালে চুলকানি ভালো হয়। তাছাড়া পাতা ভেজে গুঁড়ো করে সরিষার তেলের সাথে মিশিয়ে চুলকানিতে লাগালে যাদুর মতো কাজ হয়। নিম পাতার সাথে সামান্য কাঁচা হলুদ পিষে নিয়ে একসাথে মিশিয়ে আক্রান্ত স্থানে প্রলেপ আকারে ৭-১০ দিন ব্যবহার করলে খোস-পাঁচড়া ও পুরনো ক্ষতের উপশম হয়। নিম পাতা ঘিয়ে ভেজে সেই ঘি ক্ষতে লাগালে পুরনো ক্ষতও আরোগ্য হয়।
২. কৃমিনাশক
শিশুরাই বেশি কৃমি আক্রান্তের শিকার হয়। পেটে কৃমি হলে শিশুরা রোগা হয়ে যায়। পেট বড় হয়। চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। ৫০ মিলিগ্রাম পরিমান নিম গাছের মূলের ছালের গুঁড়া দিনে ৩ বার সামান্য গরম পানি সহ খাওয়াতে হবে। আবার ৩-৪ গ্রাম নিম ছাল চূর্ণ সামান্য পরিমাণ লবণসহ সকালে খালি পেটে নিয়মিত এক সপ্তাহ সেবন করলে কৃমির উপদ্রব হতে রক্ষা পাওয়া যায়।
৩. ত্বক
বহুদিন ধরে রূপর্চচায় নিমের পাতার বড়ি ব্যবহার হয়ে আসছে। বড়ি তৈরি করতে নিম পাতা বাতাসে একদিন রেখে দিন। ভালোভাবে ধুয়ে বেটে নিন। এবার হাতে ছোট ছোট বল করে বড়ি তৈরি করে রোদে শুকোতে দিন। নিমের বড়ির পানি একেবারে শুকিয়ে এলে এয়ারটাইট বয়ামে সংরক্ষণ করুন। ত্বকের দাগ দূর করতে এই বড়ি খুব ভালো কাজ করে। এছাড়াও এটি ত্বকে ময়েশ্চরাইজার হিসেবেও কাজ করে।
৪. নিমপাতা ফাঙ্গাস ও ব্যাকটেরিয়া বিরোধী
নিমপাতা ফাঙ্গাস ও ব্যাকটেরিয়া বিরোধী ফলে ত্বকের সুরক্ষায় এর জুড়ি নেই। মুখে ব্রণের সংক্রমণ হলে নিমপাতা থেঁতো করে লাগালে ভালো ফল ফলাফল পাওয়া যায়। তাছাড়া মাথার ত্বকে চুলকানি, চামড়ায় চুলকানি হলে নিমপাতার রস কিংবা নিমপাতা সেদ্ধ করে পানি গোসেলের পানির সাথে মিশিয়ে নিন। এতে আরাম হবে আর গায়ে দুর্গন্ধেও কমে যাবে।
৫. রক্তের সুগার লেভেল নিয়ন্ত্রণ করে
নিম ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে চমৎকার ভাবে কাজ করে। নিমের পাতা রক্তের সুগার লেভেল কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও রক্ত নালীকে প্রসারতি করে রক্ত সংবহন উন্নত করে। ভালো ফল পেতে নিমের কচি পাতার রস প্রতিদিন সকালে খালি পেটে পান করুন। সকালে খালি পেটে ৫টি গোলমরিচ ও ১০টি নিম পাতা একত্রে বেটে খেলে ডায়াবেটিস কমাতে সাহায্য করবে।
৬. চুল
চুল সুন্দর করতে নিচের তিনটি পদ্ধতির যেকোনো একটি অনুসরণ করতে পারেন। (১) প্রতি সপ্তাহে ১ দিন নিমপাতা ভালো করে বেটে চুলে লাগিয়ে ১ ঘণ্টার মত রাখুন। এবার ১ ঘন্টা পর ভালো করে ধুয়ে ফেলুন। (২) মধু ও নিমপাতার রস একত্রে মিশিয়ে সপ্তাহে কমপক্ষে ৩ দিন চুলের আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত লাগান। এবার ২০ মিনিট পর ধুয়ে ফেলুন। (৩) ১ চা চামচ আমলকির রস, ১ চা চামচ নিমপাতার রস, ১ চা চামচ লেবুর রস, প্রয়োজন অনুযায়ী টকদই মিশিয়ে সপ্তাহে ২ দিন চুলে লাগিয়ে আধঘণ্টা অপেক্ষা করারপর শ্যাম্পু করুন। চুল পড়া কমার সাথে সাথে চুল নরম ও কোমল হবে। ফলে প্রাকৃতিক ভাবেই উজ্জ্বল, সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন চুল পাবেন।
৭. উকুন বিনাশ
নিমের ব্যাবহারে উকুনের সমস্যা দূর হয়। নিমের পেস্ট তৈরি করে মাথার তালুতে ম্যাসাজ করুন, তারপর মাথা শ্যাম্পু করে ধুয়ে ফেলুন এবং উকুনের চিরুনি দিয়ে মাথা আঁচড়ান। এভাবে সপ্তাহে ২-৩ বার করে ২ মাস করুন। উকুন দূর হবে।
৮. খুশকি বিনাশ
নিমের ব্যাকটেরিয়া নাশক ও ছত্রাক নাশক উপাদানের জন্য খুশকি চিকিৎসায় কার্যকরী ভূমিকা রাখে। নিম মাথার তালুর শুষ্কতা ও চুলকানি দূর করে। চার কাপ পানিতে একমুঠো নিমের পাতা দিয়ে পানি সবুজ না হওয়া পর্যন্ত গরম করতে হবে। ঠান্ডা হলে চুল শ্যাম্পু করার পর এই পানি দিয়ে কন্ডিশনারের মতো ব্যবহার করে চুল ধুয়ে নিন। সপ্তাহে ২-৩ বার ব্যবহার করুন যতদিন না খুশকি দূর হয়।
৯. ওজন কমাতে
যদি আপনি ওজন কমাতে চান বিশেষ করে পেটের চর্বির স্তর, তাহলে নিমের ফুলের জুস খেতে হবে আপনাকে। একমুঠো নিম ফুল চূর্ণ করে নিয়ে এর সাথে এক চামচ মধু এবং আধা চামচ লেবুর রস দিয়ে ভালোভাবে মিশান। প্রতিদিন সকালে খালি পেটে এই মিশ্রণটি পান করুন। নিম ফুল মোটোবলিজম বৃদ্ধি করে শরীরের চর্বি ভাঙতে সাহায্য করে।
১০. রক্ত পরিস্কার করে
নিম পাতার রস রক্ত পরিস্কার করে ও রক্তে শর্করার মাত্রা কমায়। এছাড়াও রক্তচলাচল বাড়িয়ে হৃৎপণ্ডিরে গতি স্বাভাবিক রাখে। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রনেও ভালো কাজ করে। ।
১১. ঠান্ডাজনিত বুকের ব্যথা
অনেক সময় বুকে কফ জমে বুক ব্যথা করে। এ জন্য ৩০ ফোঁটা নিম পাতার রস সামান্য গরম পানিতে মিশিয়ে দিনে ৩/৪ বার খেলে বুকের ব্যথা কমে যাবে। তবে গর্ভবতীদের জন্য ব্যবহার না করাই ভালো।
১২. পোকা-মাকড়ের কামড়
পোকা মাকড় (যেমন মৌমাছি, বোলতা) কামড় দিলে বা হুল ফোঁটালে নিমের মূলের ছাল বা পাতা বেটে ক্ষত স্থানে লাগালে ব্যথা উপশম হবে।
১৩. জন্ডিস
জন্ডিস হলে প্রতিদিন সকালে ২৫-৩০ ফোঁটা নিম পাতার রস একটু মধুর সাথে মিশিয়ে সকালে খালি পেটে খেলে জন্ডিস আরোগ্য হয়। পুরোপুরি নিরাময় হতে এক সপ্তাহ চালিয়ে যেতে হবে।
১৪. ভাইরাস রোগ
ভারতীয় উপমহাদেশের ভাইরাল রোগ নিরাময়ে নিম ব্যবহৃত হয়। নিম পাতার রস ভাইরাস নির্মূল করে। আগে চিকেন পক্স, হাম ও অন্য চর্মরোগ হলে নিমপাতা বাটা লাগানো হতো। এছাড়াও নিমপাতা পানিতে সেদ্ধ করে সে পানি দিয়ে গোসল করলে ত্বকরে জ্বালাপোড়া ও চুলকানি দূর হয়।
১৫. ম্যালেরিয়া
নিমে গ্যাডোনিন নামের একটি উপাদান থাকে। যা ম্যালেরিয়ার ওষুধ হিসেবে কাজ করে। এছাড়াও নিমপাতা সেদ্ধ পানি ঠাণ্ডা করে ঘরে স্প্রে করলে মশার উপদ্রব কমে যাবে।
১৬. বাত
নিমপাতা, নিমের বীজ ও বাকল বাতের ব্যথা সারাতে ওষুধ হিসেবে কাজ করে। বাতের ব্যথায় নিমের তেলের ম্যাসাজও বেশ উপকারী।
১৭. চোখ
চোখে চুলকানি হলে নিমপাতা পানিতে দশ মিনিট সেদ্ধ করে ঠাণ্ডা করে নিন। চোখে সেই পানির ঝাপটা দিন। আরামবোধ হবে।
১৮. ব্রণ দূর করতে
নিমপাতার গুঁড়ো পানিতে মিশিয়ে মুখ ধুতে পারেন। এতে ব্রণ দূর হবে এবং ব্রণ থেকে তৈরি জ্বালাপোড়া ভাবও দূর হবে। এটা ব্রণ দূর করার একটি র্কাযকর পদ্ধতি।
১৯. ছত্রাকের ইনফেকশন দূর করতে
পায়ে কোন ফাঙ্গাল ইনফেকশন থাকে নিম ব্যবহার করুন। নিমে নিম্বিডল এবং জেডুনিন আছে যা ফাঙ্গাস ধ্বংস করতে পারে। নিম পাতার পেস্ট বানিয়ে আক্রান্ত স্থানে লাগালে কিংবা কয়েক ফোঁটা নিমের তেল দিন তিনবার লাগালেও ভালো ফল পাওয়া যায়।
২০. ক্ষত নিরাময়ে
হয়তো চিন্তা করছেন নিম কীভাবে ক্ষত দূর করবে? হ্যাঁ নিমপাতা ক্ষত নিরাময়ের বেশ উপকারী। নিম পাতা বেটে ক্ষতস্থানে লাগিয়ে রাখতে পারনে। এর অ্যান্টিমাইক্রোবাইরাল উপাদান ক্ষত নিরাময়ে দ্রুত কাজ করবে।
২১. অজীর্ণ
পাতলা পায়খানা হলে ৩০ ফোটা নিম পাতার রস, এক কাপ পানির ৪/১ ভাগ পানির সঙ্গে মিশিয়ে সকাল-বিকাল খাওয়ালে উপকার পাওয়া যাবে।
২২. অ্যালার্জি
অ্যালার্জি সমস্যায় নিম পাতা ফুটিয়ে গোসল করুন। তাছাড়া কাঁচা হলুদ ও নিম পাতা একসাথে বেটে শরীরে লাগালে অ্যালার্জি কমে যাবে।
২৩. একজিমা
একজিমা, ফোঁড়া অথবা বিভিন্ন ধরনের ত্বকের সমস্যা নিরাময়ে নিম খুব র্কাযকর। ত্বকের যেসব জায়গায় এ ধরনের সমস্যা রয়েছে সেখানে নিমপাতা বেটে লাগাতে পারেন।
তথ্যসূত্র : অর্থসূচক